" পৃথিবীর ‘ভূস্বর্গ’ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র কাশ্মীর: কেন এই সংঘাত, রক্তক্ষরণ? "

পৃথিবীর ‘ভূস্বর্গ’ থেকে যুদ্ধক্ষেত্র কাশ্মীর: কেন এই সংঘাত, রক্তক্ষরণ?

 

প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের নাম কাশ্মীর। বরফঢাকা পাহাড়, কলকলিয়ে বয়ে চলা ঝরনা, শাল গাছের সারি আর লেকের শান্ত জলে প্রতিফলিত সূর্যাস্তের ছবি যেন স্বর্গের মতো। অথচ এই অপরূপ উপত্যকাই আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকৃত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। হাজারো সৈন্যের ছায়া, আধা সামরিক বাহিনীর টহল আর কাঁটাতারে ঘেরা জনপদই এখন কাশ্মীরের বাস্তব চিত্র।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর, কাশ্মীর সংকটের সূচনা ঘটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান—দুই স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর নামের এই সুপ্রাচীন রাজ্যের ভাগ্য রয়ে যায় ঝুলে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা হরি সিং স্বাধীনতার পথ খুঁজছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতীয়দের হামলার মুখে তিনি ভারতের কাছে সহায়তা চান এবং একটি অধিগ্রহণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

ভারতের সেনারা কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং উপত্যকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের দখল নেয়। অপরদিকে, আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে তার উপস্থিতি। এর ঠিক কয়েক বছর পর পূর্ব অংশ আকসাই চীনের দখল নেয় চীন। সেই থেকে তিন দেশের দাবির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এই ভূখণ্ড।

১৯৪৭ সালের পর আরও দুটি বড় যুদ্ধ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর সীমান্তকে কেন্দ্র করে ঘটে ভয়াবহ সংঘর্ষ। অনেক প্রাণহানির পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কাশ্মীর পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিতে নিয়ন্ত্রণরেখা (LOC) নির্ধারিত হলেও উত্তেজনার অবসান হয়নি। ১৯৯৯ সালে কারগিল সীমান্তে আবারও রক্তপাত হয়। শুধু পাকিস্তান নয়, চীনের সাথেও কাশ্মীর সীমান্তে একাধিকবার বিবাদে জড়িয়েছে ভারত। ফলে ভূ-রাজনৈতিকভাবে কাশ্মীর হয়ে ওঠে এক অগ্নিগর্ভ অঞ্চল, যা আজও জ্বলছে।

সমস্যা কেবল বাইরের হুমকি নিয়ে নয়, কাশ্মীরের ভেতরেও চলছে দীর্ঘ বিদ্রোহ। ১৯৮০ সালের শুরুতে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধে সাধারণ মানুষের মধ্যে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ নেয় সশস্ত্র আন্দোলনে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করতে ভারত মোতায়েন করে হাজার হাজার সেনা। এই প্রক্রিয়ায় অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রাণ হারায়।

২০১৬ সালে উরিতে জঙ্গি হামলায় ১৯ ভারতীয় সেনা নিহত হলে ভারত সীমান্ত পেরিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালায়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন ৪০ জন আধা সামরিক জওয়ান। জবাবে ভারতের বায়ুসেনা বালাকোটে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। সেই একই বছর আগস্টে মোদি সরকার জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে দেয়। ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ বাতিল করে রাজ্যটিকে ভাগ করা হয় দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে—জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ। দিল্লি দাবি করে কাশ্মীরে শান্তি ফিরেছে, বেড়েছে পর্যটক। বাস্তবে এই দাবি কতটা সত্য, তা নিয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। গুপ্ত হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিক্ষোভ—এসব এখনো সময়-সময় রক্তাক্ত করে উপত্যকাকে।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হওয়া সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়। ঘটনার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। এর প্রতিশোধ নিতে ভারত চালায় ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে ঝটিকা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। পাকিস্তানের ছয়টি শহরে এবং আজাদ কাশ্মীরের তিনটি অঞ্চলে এই হামলা চালানো হয়। ভারত দাবি করে, তারা জঙ্গি গোষ্ঠী জয়েশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার ঘাঁটি ধ্বংস করেছে এবং অন্তত ৭০ জন জঙ্গিকে হত্যা করেছে। পাকিস্তান পাল্টা দাবি করেছে, নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক, এবং তাদের সেনাবাহিনী পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে।

ঘটনার জেরে দুই দেশের সীমান্তে চলছে তুমুল গোলাগুলি, বিমানবাহিনী সরব, সেনারা প্রস্তুত। জম্মু ও কাশ্মীরে লাইন অব কন্ট্রোলে শিশু ও নারীসহ বহু সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও তৈরি হয়েছে নতুন উত্তেজনা। পাকিস্তানে কারাবন্দি ইমরান খানের পুরনো একটি ভিডিও নতুন করে ভাইরাল হয়ে রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি করেছে। ভিডিওতে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণ অনেককে উজ্জীবিত করেছে। তার সমর্থকেরা বলছেন, এই সংকটে ইমরান খানই হতে পারেন জাতির নেতা। সরকারের প্রতি আস্থা হারানো জনগণের একাংশ নতুন করে ঐক্যের ডাক দিচ্ছে তার মুক্তির পক্ষে।

Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال