" শহীদ ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দিন কাটে আমোদ আলীর "

শহীদ ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দিন কাটে আমোদ আলীর



৭ বছর আগে দরিদ্র পরিবারের হাল ধরতে ঢাকায় যেতে হয় সাব্বিরকে। জীবন ধারনের তাগিদে কখনো টাইলস মিস্ত্রী, কখনো নির্মাণ শ্রমিকসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেন। জুলাই আন্দোলনের সময় প্রথম থেকেই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এরপরই ঢাকার উত্তরা-আজমপুর এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত হন ঝিনাইদহের সাব্বির হোসেন (২৩)। পরিবার তার হত্যার বিচার চায়। 

সাব্বির হোসেন ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের আমোদ আলীর ছেলে। আমোদ আলী-রাফিজা খাতুন দম্পতির ৩ ছেলে-মেয়ের মধ্যে সাব্বির ছিলেন বড়। মূলত তার উপার্জিত টাকা দিয়েই চলতো পরিবারের সব খরচ। একদিকে ছেলে হারানো বেদনা অন্যদিকে অভাব পরিবারটিকে এখন দিশেহারা করে দিয়েছে। তবে এলাকার অন্যতম প্রিয় ছেলে ছিল সে। বাড়িতে ফিরলে ছোট-বড় সবার সঙ্গে ছিল তার খুব ভালো সম্পর্ক।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কৃষক বাবা আমোদ আলীর বেশিরভাগ সময়ই কাটে বড় ছেলে সাব্বিরের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে। কখনও গ্রামবাসী তার সঙ্গে থাকে আবার কখনও তিনি একাই সময় কাটান সেখানে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকেন আনমনে। পুলিশের গুলি গলার এপাশ থেকে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় সাব্বিরের। পরিবারের ভার কাঁধে তুলে নেওয়া সন্তানকে আর তো কোনদিন ফিরে পাবেন না। শুধু চান অপরাধীদের যেন বিচার হয়, কঠিন বিচার। 

জানা যায়, উত্তরার ১৩নং সেক্টরে অর্গান লিমিটেড কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন তিনি। গত ১৮ জুলাই দুপুরে কর্মস্থল থেকে বের হয়ে ঢাকার আজমপুর এলাকায় চলমান সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় গলায় গুলিবিদ্ধ হন। গুলি খাওয়ার পর সাব্বিরকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট মিজানুর রহমান তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সাব্বির নিহত হওয়ার খবরটি প্রথমে তার চাচাতো ভাই বাড়িতে জানায়।

সাব্বিরের বাবা আমোদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি কৃষি কাজ করি। নিজের মাঠে দেড় বিঘা কৃষি জমি আছে। এছাড়া লিজ বর্গা নিয়ে দু-তিন বিঘা চাষাবাদ করি। এই চাষাবাদের মধ্য দিয়েই কোনো রকম চলতে হয়। বড় ছেলে সাব্বির ঢাকায় গিয়ে কাজ করে যে টাকা পয়সা পাঠাতো, তাতে মোটামুটি ভালো চলত। প্রথমে টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে, ওখানে কিছুদিন কাজ করার পরে একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। এই সমস্ত কাজ কাম করেই আমার পরিবারে সহযোগিতা করত। 

আমোদ আলী বলেন, সাব্বির মারা যাওয়ার এক দিন আগে আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে। কোন জমিতে কোন ফসল কেমন হয়েছে। পাট কেমন হয়েছে? মাঠের চাষবাস কেমন হচ্ছে? ওই দিন এসব নিয়েই কথা হয়। পরের দিন আমি মাঠে কাজ করছিলাম। কাজ শেষের দিকে, গ্রামের দুটি ছেলে গিয়ে আমাকে খুঁজতে থাকে। পরে তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা দুজন আমাকে বলে চাচা বাড়িতে একটু সমস্যা হয়েছে দ্রুত বাড়ি চলেন। তখন আমি তাদের কাছে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? তারা আমার কথার কোন উত্তর দেয় না। শুধু বলে দ্রুত বাড়ি চলেন বাড়িতে গিয়ে বলব। এরপর কাজ কাম ছেড়ে বাইসাইকেল নিয়ে বাড়ির দিকে আসি। ওই ছেলে দুটো আমার পিছে পিছে আসতে থাকে। এরপর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই পরিচিত একটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করি আমার বাড়িতে কি হয়েছে। তখন ওই ছেলে বলে তোমার সাব্বিরের গুলি লেগেছে। তখন বাড়িতে ঢুকেই দেখি বাড়ি ভর্তি অনেক লোকজন। তারপরে জানতে পারি সাব্বির পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। সাব্বির পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়ার খবর শুনে গ্রামের আওয়ামী লীগের লোকজন অনেক খারাপ মন্তব্য করছিল।

তিনি আরও বলেন, সাব্বির আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের জন্য রাজপথে আন্দোলন করতে গেছিল। আন্দোলন করতে গিয়েই পুলিশের গুলিতে  মারা যায়। আমি চাই আমাদের গ্রামে ছেলের নামে যেন একটি মসজিদ, মাদরাসা কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়। যা তার ছেলের আত্মাকে শান্তি দেবে।

সাব্বিরের মা রাফিজা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাব্বির যে আন্দোলনে গেছে সেটা আমরা জানতাম না। ওর মৃত্যুর পরে জানতে পেলাম সে আন্দোলনে গিয়েছিল। আন্দোলনে গিয়ে মারা যাওয়ার পর, আমাদের এলাকার আওয়ামী লীগের লোকজন অনেক খারাপ খারাপ কথা বলে। সংসারে অভাব দেখে ঢাকায় গিয়ে কাজ করতো আর আমাদের কাছে টাকা পাঠাতো। সাব্বির মাদরাসার লাইনে লেখাপড়া করেছে। সে কুরআনের চার পারা হাফেজ। আমি যদি জানতাম আমার সন্তান ঢাকাতে গিয়ে এভাবে মারা যাবে আমি কখনোই তাকে ঢাকায় পাঠাতাম না। 

তিনি বলেন, সাব্বির মারা যাওয়ার পর জামায়েত ইসলাম, বিএনপি, গণধিকার পরিষদ এবং ছাত্ররাসহ সরকারিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে। এখন আমি সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে কি করব? এখন তো লাখ লাখ টাকা দিয়েও আমার সাব্বিরকে ফিরিয়ে আনতে পারব না।

তিনি বলেন, ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক থেকে দুই কিস্তিতে ২ লাখ টাকা, খুলনা জুলাই অভ্যুত্থান ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামী দুই লাখ টাকা, বিএনপি দুই বারে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ছাত্ররা একটা ষাঁড় গরু কিনে দিয়েছে। এছাড়া নিয়মিত সবাই আমাদের খোঁজখবর নেয়। এছাড়া মীর্জাপুর গ্রামে সাব্বির হোসেনের নামে শহীদ সাব্বির সড়কের উন্মোচন করা হয়েছে। এখন যারা এই আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছে সব শহীদের হত্যার বিচার চাই
Previous Post Next Post

Random Manga

Ads

نموذج الاتصال